সেলিম উদ্দিন, ঈদগাঁও ::
কক্সবাজার প্রতিনিধি, চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের কাঠালিয়া পাহাড়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ মিয়া (৫৩) বলেন, এক সময় আমাদের মতো গরীব মানুষদের রোদ-বর্ষার হাত থেকে বাঁচাইতো গোল পাতা। বাপ-দাদা আমলে দেখছি গোলপাতা দিয়া ঘরের চাল ছাইতে (তৈরী করতে)। পয়সা খরচ করে গোলপাতা নিতে হত না। জংলা জায়গা, খালের পাড়ে সারি সারি গোল গাছ ছিল। গোল গাছের ফল ছিল ছেলে-মেয়েদের মজার খাদ্য। আর গোল গাছের রস স্থানীয় ভাষায় তারি ছিল খুবই স্বাদের। এই তারি পেটের পিড়া ও অন্যন্য রোগে ব্যবহার হত। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এখন আর সেই দিন নাই। গোলপাতা পেতে হলে সারা ফুলছড়ি গ্রাম ঘুরে একমাত্র কাঠালিয়া পাহাড়ে হয়তো পাওয়া যেতে পারে। উপজেলার আংশিক উপকূলীয় এলাকা খুটাখালী থেকে ক্রমেই গোলপাতা গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় চাষাবাদ, সংরক্ষণের অভাব সর্বোপরি জলবায়ুর প্রভাবে গোলপাতা গাছের বিলুপ্তির কারণ বলে মনে করছেন স্থানীয় লোকজন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এক সময়ে খুটাখালীর ফুলছড়ি, টকটকি ঘোনা, বহলতলী লোকালয়ের খাল, বিল, নদীর তীর ও মোহনায় প্রচুর পরিমাণে গোলপাতা গাছ জন্মাতো। ৩০ বছর আগেও শুধু মাত্র উপজেলার খুটাখালীর ফুলছড়ি, টকটকি ঘোনা, বহলতলীতে প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে গোলপাতা গাছ পাওয়া যেত। গোলপাতা গাছের পরিকল্পিত চাষাবাদ খুব একটা না থাকলেও এসব গ্রামের খালের দু’পাড়ে এবং নিচু ও জলাভূমিতে প্রাকৃতিক ভাবেই গোলপাতা গাছ জন্মাতো। গোলপাতা গাছের ঘন জংগলে বাঘ দাস, শিয়াল, বন্য মুরগীর অভয় আশ্রম ছিল বলে উত্তর ফুলছড়ি গ্রামের মাষ্টার বশির আহমদ আলাপকালে জানান। কিন্তু বর্তমানে মহেষখালী সাগর তীরবর্তী টকটকি ঘোনা, বহলতলী এলাকায় গোলপাতা নেই বললেই চলে। ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকা ফুলছড়ি কাঠালিয়া পাহাড়ে মাত্র ১ কানি জমিতে গোলপাতা গাছের দেখা মিলেছে। গাছের নাম ‘গোল’ হলেও এর পাতাগুলো দেখতে নারকেল গাছের পাতার মতো। সাধারণত একটি গোলপাতা গাছ লম্বায় ১০ থেকে ১৫ ফুট, কখনও ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, লবনাক্ত পলিযুক্ত মাটিতে গোলপাতা গাছ ভাল জন্মায়। বিস্তীর্ণ এলাকাসহ খালের ধার ও নদীর চরাঞ্চল গোলপাতা গাছ চাষের উপযুক্ত স্থান। গোলপাতা গাছের বীজ (গাবনা) মাটিতে পুঁতে রাখলেই চারা জন্মায়। একেকটি গাবনায় ১৩০ থেকে ১৫০টি পর্যন্ত বীজ থাকে। গোলপাতা গাছ চাষে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়না। কীটনাশক বা রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়না, পরিচর্যারও দরকার পড়ে না গোলপাতা গাছ চাষে। বীজ সহজলভ্য ও চাষে ব্যয় কম হওয়ায় গোলপাতা চাষ খুবই লাভজনক বলেও জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
উত্তর ফুলছড়ি গ্রামের মাওলানা রফিকুল ইসলাম জানান, গোল পাতা গাছের কোন অংশই ফেলনা নয়। গোলপাতা ঘরের বেড়া ও চাল তৈরীতে ব্যবহার করা হয়। পুরনো বা শুকনা পাতা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গোল গাছের ফল পুষ্টিকর খাদ্য। গোলের রস থেকে সুস্বাদু রস বা তারি তৈরী করা হয়।
খুটাখালী ইউপি চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রহমান বলেন, ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকা হিসেবে কাঠালিয়া পাহাড় বিস্তীর্ন এলাকায় একসময় গোলপাতা গাছ চাষের অনুকূল পরিবেশ ছিল। বর্তমানে খুটাখালী ছড়া ভাঙ্গন, মাটি ও পানিতে লবনাক্ততা বৃদ্ধির মতো জলবায়ু’র পরিবর্তন প্রাকৃতিকভাবে গোলপাতা গাছ জন্মানোর হার কমেছে। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগে নেয়া হলে গোলপাতা গাছ চাষ পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
পাঠকের মতামত: